বিবাহিত মহিলারা পিরিয়ড বাদ গেলেই চিন্তায় পড়ে যান তারা গর্ভবতী কিনা। তবে কেবলমাত্র সন্তানসম্ভবা হলেই পিরিয়ড বন্ধ হয় না। পিরিয়ড বন্ধের পিছনে থাকতে পারে বিভিন্ন কারণ। যার মধ্যে অন্যতম পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম এবং অত্যধিক জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল খাওয়া, ডায়াবেটিস কিংবা কোন রোগের কারণে।
গর্ভবতী হলে কেবলমাত্র পিরিয়ড বন্ধ হয় তা নয়। এর পাশাপাশি শরীরে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে দেখা যায় বেশ কিছু লক্ষণ। তবে প্রতিটি মহিলার ক্ষেত্রেই সব উপসর্গগুলি নাও দেখা দিতে পারে। শরীরের গঠনভেদে গর্ভবতী হলে বিভিন্ন উপসর্গ চোখে পড়ে। এরই মধ্যে কয়েকটি প্রাথমিক লক্ষণ রয়েছে যেগুলি প্রায় গর্ভবতী হলে সব মহিলাদের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। আজ এমনই কয়েকটি লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করা হবে।
গর্ভাবস্থার লক্ষন :
প্রথমেই আপনি গর্ভবতী কিনা তা জানতে একটি গর্ভাবস্থার পরীক্ষার কিট দিয়ে ঘরে সেটিকে পরীক্ষা করে নিতে হবে। সেখানে রেজাল্ট পজিটিভ এলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। তবে গর্ভাবস্থার শুরুতেই বেশ কিছু উপসর্গ দেখা যায়। মূলত গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে বমি বমি ভাব, ক্লান্তি, সকালের দিকে অসুস্থতা, হঠাৎ ওজন বৃদ্ধি, ঘন ঘন মূত্র ত্যাগের প্রবণতা দেখা যায়। এবার দেখে নেওয়া যাক প্রথম সপ্তাহ থেকে কোন সমস্যা গুলির সম্মুখীন হতে হয় হবু মাকে। (1)
প্রথম সপ্তাহ থেকে গর্ভাবস্থার লক্ষন :
- হঠাৎ স্তন বৃদ্ধি : সন্তানসম্ভবা হওয়ার ফলে নারীদের শরীরে হঠাৎ হরমোন পরিবর্তন দেখা যায়। যে কারণে প্রথমেই শরীরের অন্যতম কোমল অংশ হওয়ায় স্তনের মধ্যে সেগুলির পরিবর্তন মূলত লক্ষ করা যায়। ফলস্বরূপ হঠাৎ স্তনের আকার বৃদ্ধি পায়। (2)
- অল্প রক্তপাত : গর্ভধারণের পরে প্রথম ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে স্বল্প রক্তপাত হতে দেখা যায়। তবে সকল মহিলাদের ক্ষেত্রে এই উপসর্গটি দেখা নাও দিতে পারে। কিছু কিছু নারীদের শরীরে এই লক্ষণটি চোখে পড়ে। (3)
- সকালের দিকে অসুস্থতা : গর্ভবতী মায়েদের সকালের দিকে মূলত বমি ভাব এবং মাথা যন্ত্রণার উপসর্গ দেখা দেয়। এটিকে ডাক্তারি পরিভাষায় মর্নিং সিকনেস সমস্যা বলা হয়। গর্ভধারণের ৬ সপ্তাহের কাছাকাছি সময়ে শরীরে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে এই উপসর্গটি লক্ষ্য করা যায়।
- ঘন ঘন মূত্র ত্যাগ : গর্ভধারণের ফলে মহিলাদের দেহে হঠাৎ হরমোন পরিবর্তনের কারণে রক্তের চাপ বৃদ্ধি পায়। যে কারণে কিডনি আরো সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং শরীর থেকে ক্ষতিকর তরল পদার্থ গুলিকে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়। যার ফলে গর্ভবতী মায়ের ঘন ঘন মূত্র ত্যাগের উপসর্গটি লক্ষ্য করা যায়।
- ক্লান্তি : গর্ভবতী মায়ের শরীরে শিশু ভ্রুণটি বেড়ে ওঠার পাশাপাশি মায়ের ক্লান্তি বেড়ে যায়। মূলত প্রজেস্টেরন স্তরের বৃদ্ধির কারণে হবু মায়ের শরীরে ক্লান্তি অনুভব হয়। কেননা মায়ের শরীর থেকেই শিশু তার প্রয়োজনীয় শারীরিক চাহিদা মেটায়। যে কারণে শিশুটি নিজের শরীর গঠনের জন্য সমস্ত রকম পুষ্টি মায়ের শরীর থেকেই নিয়ে থাকে। ফলে মায়ের শরীরে ক্লান্তি দেখা দেয়।
- মেজাজের পরিবর্তন : শরীরে হঠাৎ হরমোন পরিবর্তনের কারণে তা গর্ভবতী মহিলার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি বিভিন্ন সময় অতিরিক্ত আবেগ লক্ষ্য করা যায় মায়েদের মধ্যে যা গর্ভাবস্থার একটি সাধারণ লক্ষণ।
- হৃদরোগের সমস্যা : গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে কখনও কখনও হৃদরোগের সমস্যা দেখা যায়। মূলত এই সময় বিভিন্ন হরমোন গুলির পরিবর্তনের কারণে এই উপসর্গটি দেখা যায়। পেটে গ্যাস কিংবা খাবার হজমের সমস্যা বা অ্যাসিডিটির সমস্যা হলে তা গর্ভাবস্থায় পেটের উপরে চাপ সৃষ্টি করে। যার ফলে হৃদরোগ দেখা যায়। যে কারণে এই সময়ে বেশি মশলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। কেননা এই সমস্ত খাবার গুলি সঠিকভাবে হজম না হলে হৃদরোগের সমস্যা বেড়ে যায়।(4)
- শরীরে ফুসকুড়ি : হঠাৎ প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে শরীরে পাচন প্রক্রিয়া ধীর গতিতে কাজ করে। যে কারণে হবু মায়ের শরীরের বিভিন্ন অংশে ছোট ছোট দানা দানা বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়।
- কোষ্ঠকাঠিন্য : শরীরে হরমোনের পরিমাণ বৃদ্ধি হওয়ার কারণে পাচনতন্ত্র ধীর গতিতে কাজ করে। ফলে খাবার হজম হতে সময় লাগে। যে কারণে গর্ভবতী মহিলাদের কোষ্ঠকাঠিন্য লক্ষ্য করা যায়। তবে কোষ্ঠকাঠিন্যের পরিমাণ যদি বৃদ্ধি পায় সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করে করতে হবে।
- পেটে হালকা ব্যথা : গর্ভাবস্থায় প্রথম কয়েক সপ্তাহ পর শিশুটির বৃদ্ধির সাথে সাথে গর্ভাশয়ের বৃদ্ধির কারণে পেটে হালকা ব্যথা হতে পারে। এই উপসর্গটি প্রায় সব গর্ভবতী মহিলার ক্ষেত্রেই দেখা যায়।
- মাথা ব্যথা : শরীরে রক্তের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এবং হরমোনের অত্যধিক মাত্রায় পরিবর্তনের কারণে গর্ভবতী মহিলার মাথা ঘোরানো কিংবা মাথা ব্যথার মতন উপসর্গগুলি দেখা দিতে পারে। তাছাড়াও রক্তে শর্করার পরিমাণ কম, ডিহাইড্রেশন কিংবা বমি বমি ভাব হলেও এই উপসর্গ লক্ষ্য করা যেতে পারে। (5)
- খাদ্যে অনীহা : গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে দেখা যায় বিশেষ কিছু খাবারে অনীহা। এমনকি শরীরের অভ্যন্তরে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে খাবারের মধ্যে একপ্রকার গন্ধ পায় তারা, যার কারণে পেটে খিদে থাকলেও ঠিক মতন খাবার খেতে পারে না তারা। কিংবা অনেক সময় দেখা যায় কোন খাবারের গন্ধের কারণে বমি ভাব লক্ষ্য করা যায়। যার ফলে উপযুক্ত পরিমাণ খাবার খেতে না পারার ফলে গর্ভবতী মহিলার শরীর আরো দুর্বল হয়ে ওঠে।
- ব্রণর সমস্যা : শরীরে হরমোনের মাত্রা বাড়তে থাকার কারণে গর্ভবতী মায়ের মুখে ব্রণ দেখা যায়। মূলত গর্ভাবস্থায় বেশ কিছু মহিলাদের মুখের ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় এবং ব্রণ ও কালো দাগ লক্ষ্য করা যায়। মূলত গর্ভাবস্থার কারনে শরীরের রক্ত প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার কারণে এক ধরনের তেল উৎপন্ন হয় যেগুলি মুখে ব্রণের সমস্যা তৈরি করে। এছাড়াও গর্ভাবস্থায় মেলানিনের বৃদ্ধি হওয়ার কারণে মুখে কালো দাগ লক্ষ্য করা যায়।
- উজ্জ্বল ত্বক : অনেক সময় গর্ভাবস্থায় গর্ভবতী মায়ের ত্বকে একটি আলাদা ঔজ্জল্য চোখে পড়ে। মূলত হরমোনের প্রবাহ রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি করার কারণে ত্বকের উজ্জ্বল্য মুখে প্রকাশ পায়। যার ফলে শরীরে রক্ত প্রবাহের কারণে একটি আলাদা চকচকে ভাব লক্ষ্য করা যায়।
- দ্রুত হৃদস্পন্দন : শরীরে অক্সিজেন এবং পুষ্টির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে গর্ভবতী মায়েদের হৃদস্পন্দনের হার বৃদ্ধি পায়। মূলত শরীরকে সচল রাখতে রক্তে প্রবাহ দ্রুত গতিতে সম্পন্ন করতে হয় হৃদয়কে। যার কারনে এর গতি বৃদ্ধি পায়।
- মুখে অরুচি ভাব : হরমোনের পরিবর্তনের কারণে গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে শরীরের কিছু কিছু অঙ্গ সঠিকভাবে কাজ করে উঠতে পারে না। মূলত গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে শরীরের হঠাৎ হরমোনের পরিবর্তন বুঝে উঠতে সময় নেয় শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলি। যে কারণে গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে গর্ভবতী মহিলাদের মুখে অরুচি দেখা যায়। তবে একবার হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক হয়ে গেলে এই অরুচি ভাব নিজে থেকেই চলে যায়।
গর্ভধারনের লক্ষণ:
এগুলি তো হল গর্ভাবস্থার প্রাথমিক লক্ষণ। এই লক্ষণ গুলি দেখে বুঝতে পারা যাবে আপনার শরীরে একটি ছোট্ট প্রাণ আসতে চলেছে। তবে তার আগে আপনি গর্ভবতী কিনা সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কেবলমাত্র পিরিয়ড বাদ গেলেই যে গর্ভবতী হয় না সেই বিষয়টি আমরা আগেই জেনেছি। গর্ভবতী হতে গেলে পিরিয়ড বাদ পড়ার পাশাপাশি উপরিউক্ত উপসর্গগুলি শরীরে লক্ষ্য করা যাবে। তবে আপনি গর্ভবতী কিনা সেটি পরীক্ষা করে দেখার জন্য উপযুক্ত সময় পিরিয়ড বাদ যাবার পরবর্তী সময়টি। তবে গর্ভধারণের বিষয়টি কেবলমাত্র ঘরে গর্ভধারণের পরীক্ষার কিট দিয়েই শনাক্ত করে নিশ্চিত হওয়া যায় না। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক রক্ত পরীক্ষা। এর পাশাপাশি সঠিকভাবে আলট্রাসনোগ্রাফি পদ্ধতির মধ্য দিয়েই গর্ভধারণের বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়। (6)
মা হওয়ার লক্ষণগুলি :
প্রথমেই আমরা জেনে নিয়েছি গর্ভবতী হলে মহিলাদের শরীরে কোন কোন উপসর্গগুলি লক্ষণীয় কিংবা কিভাবে আমরা নিজেদের গর্ভধারণ নিশ্চিত করব। এবার মা হতে গেলে মোট ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত কি কি শারীরিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হবে সেই বিষয়টি জেনে নেওয়া যাক। গর্ভধারণের প্রথম এক থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে মূত্রের সাথে হালকা রক্তপাত হতে দেখা যায়। এরপর চতুর্থ থেকে পঞ্চম সপ্তাহ শরীরে হঠাৎ হরমোনের পরিবর্তনের কারণে এক ধরনের অবসাদ লক্ষ্য করা যায় গর্ভবতী মায়ের। পরবর্তী চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ সপ্তাহ পর্যন্ত শরীরে হরমোনের পরিবর্তন এবং শিশু ভ্রূনটি গঠনের সময় সারাক্ষন বমি ভাব লক্ষ্য করা যায়। এর পাশাপাশি এই সময় হঠাৎ স্তন বৃদ্ধি এবং ঘন ঘন মূত্র ত্যাগ, পেটের ভেতর বুদবুদ ভাব লক্ষ্য করা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কখনো অত্যধিক আবেগপ্রবণ কিংবা কখনো মানসিক অবসাদগ্রস্ত দেখা যায়। এর পাশাপাশি শরীরের তাপমাত্রার পরিবর্তন হতে থাকে। গর্ভধারণের অষ্টম সপ্তাহে এসে গর্ভবতী মায়ের শরীরে উচ্চ রক্তচাপ লক্ষ্য করা যায়। এর পাশাপাশি অষ্টম থেকে দশম সপ্তাহ পর্যন্ত হৃদস্পন্দন দ্রুত গতিতে চলতে থাকে এবং নবম সপ্তাহে শরীরে চরম ক্লান্তি এবং সারা শরীরে এক ধরনের জ্বালা ভাব লক্ষ্য করা যায়। গর্ভধারণের ১১ সপ্তাহে এসে স্তন এবং স্তনবৃন্তের পরিবর্তন, হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মুখে ব্রণ এবং হঠাৎ ওজন বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়।
এই ভাবেই মায়ের শরীরের ভিতর ভ্রূণটি বেড়ে ওঠার পাশাপাশি গর্ভবতী মায়ের শরীরের পরিবর্তন হতে থাকে।তবে এই শারীরিক পরিবর্তন গুলি কখনো যদি অতিরিক্ত মাত্রায় লক্ষ্য করা যায় তাহলে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের সাথে উপসর্গটি নিয়ে কথা বলুন। এবং হবু মায়েরা একবার ভেবে নিন আপনি এগুলির মধ্যে দিয়ে কোন কোন উপসর্গের মধ্য দিয়ে এখন যাচ্ছেন।